১৯৭২ সাল থেকেই জাতিসংঘ ও সদস্য দেশগুলো পৃথিবীর পরিবেশ রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছে। বিপন্ন বন্যপ্রাণীর বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে ১৯৭৩ সালে গ্রহণ করা হয় আন্তর্জাতিক বিপন্ন বন্য উদ্ভিদ ও প্রাণী বাণিজ্য বিষয়ক কনভেনশন (সাইটেস)। এ সনদে স্বাক্ষরকারী ১৮২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। তার মানে, পৃথিবীর ১৮২টি দেশই বন্যপ্রাণীর অবৈধ বাণিজ্য বন্ধ করতে চায়। তাতেও রক্ষা পাচ্ছে না বন্যপ্রাণীরা।
পাভেল পার্থ আমাদের বন্ধু। জনপ্রতিবেশবিদ্যা নিয়ে কাজ করার জন্য পরিচিত তিনি। একদিনের আড্ডায় বাঘের সংখ্যা নিয়ে কথা উঠলে তিনি বললেন, ‘১৯৬০-এর দশক থেকেই বাংলাদেশে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা দেখা যাচ্ছে ৩৫০-৪৫০টি। পৃথিবীতে জন্ম-মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পৃথিবীর সব প্রাণীর সংখ্যা বৃদ্ধি হয়। বাঘের কি এগুলো কিছুই হয় না?’ আমরা অনেকক্ষণ বিষয়টি নিয়ে মজা করলেও ঘটনাটি কিন্তু মোটেই মজার নয়।
সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে আধুনিক যন্ত্রপাতি কাজে লাগিয়ে সরকারিভাবে যে গবেষণা হয়েছে, তাতে বাঘের সংখ্যা পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ১০৬টি। অথচ ‘জলে কুমির ডাঙায় বাঘ’ বলেই সুন্দরবনের সাধারণ পরিচয় দেওয়া হয়। বাঘ কমেছে, কিন্তু কুমির বেড়েছে_ এমনটা নয় কিন্তু। ষাট ও সত্তরের দশকে সুন্দরবন-সংলগ্ন অঞ্চলে মানুষ কুমিরের ভয়ে নদীতে স্নান করতে নামত না। তখনকার হিসাব অনুসারে সুন্দরবনে নোনাপানির কুমিরের সংখ্যা ছিল দেড় হাজারেরও বেশি। এখন তা কমতে কমতে এসে দাঁড়িয়েছে ২০০-২৫০টিতে। দেড় লাখ থেকে হরিণের সংখ্যাও নেমে এসেছে ৫০ হাজারে।
আর হারিয়ে যাওয়ার দলে প্রতিদিন যোগ হচ্ছে নতুন নতুন বন্যপ্রাণ। ইতিমধ্যে যা যা হারিয়ে গেছে কাঁদলে তা ফিরে পাওয়া যাবে না। পারা হরিণ বা কুকুরে হরিণ, বারো শিঙ্গা, বুনো ষাঁড়, জাভা গণ্ডার, চিতাবাঘের পাশাপাশি হারিয়ে গেছে বুনো মহিষও, যা ষাটের দশকেও দলে দলে চরে বেড়াত বলে সুন্দরবনের ইতিহাসবিদ এএফএম আবদুুল জলিল লিখে গেছেন। পাখির মধ্যে সাদা মানিকজোড়, কানঠুনি, বোঁচা হাঁস, গগনবেড়, জলার তিতিরসহ অন্তত ১৫টি প্রজাতি আর কোনোদিন সুন্দরবনে দেখা যাবে কি-না সন্দেহ। রয়না, কালো হাঙ্গর, তীরন্দাজ, জাভা, কাইক্কা, কাজলী, শিলং, কাইন মাগুর, দাতিনা, লাক্ষাসহ ১৫-২০ প্রজাতির মাছ হয় এখন আর পাওয়া যায় না, নতুবা খুব দ্রুতই হারিয়ে যাবে এ অঞ্চল থেকে।
বন্যপ্রাণ উজাড় হয়ে যাওয়ার পেছনে যে শুধু অতিরিক্ত সংগ্রহ ও চোরাই শিকার দায়ী, তা নয়। উজানে আড়বাঁধ দেওয়ার ফলে সুন্দরবনে স্বাদুপানির অভাব, নদী-খাল মরে যাওয়ায় প্রতিবেশের অধঃপাত, জলোচ্ছ্বাসে বনের ভেতরে নোনাপানি প্রবেশ, বৃক্ষনিধনের ফলে আবাসস্থল ধ্বংস হওয়া, অতিরিক্ত পর্যটকের আনাগোনা, শব্দদূষণ, বিসদৃশ রঙিন ও চকচকে অবকাঠামো এবং উজানের বর্জ্যও কম দায়ী নয়।
সর্বশেষ দায়টি দিয়েছে স্বয়ং বিশ্ব বন্যপ্রাণ তহবিল (ডবি্লউডবি্লউএফ)। এ বছর এপ্রিলে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিশ্বসংস্থাটি বলছে, সুন্দরবনের বন্যপ্রাণীর বিপন্নতার কারণ মূলত পাঁচটি :বনসংলগ্ন এলাকায় ভারী শিল্প নির্মাণ, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জাহাজসহ নৌযান চলাচল, অতিরিক্ত মৎস্য সংগ্রহ, বৃক্ষনিধন এবং অদূরদর্শী পানি ব্যবস্থাপনা।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় একক বাদাবন সুন্দরবন ও তার বন্যপ্রাণ বাঁচাতে এখনই ক্ষতিকর উদ্যোগগুলো বন্ধ করা ও ব্যাপকভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই।