![]() |
Hasan Mehedi, Chief Executive, CLEAN |
মোটকথা, পৃথিবীতে যে হারে বন্যপ্রাণ কমে যাচ্ছে তা সবাইকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। জাতিসঙ্ঘের হিসাবমতে, গণ্ডার, হাতি, গরিলা, শিম্পাঞ্জি, বাঘ, বনরুই ও মাছের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। কেন কমে যাচ্ছে? জাতিসঙ্ঘেরই আরেক হিসাবমতে, বন্যপ্রাণী পাচারে এ বছর ২০ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা অবৈধ লেনদেন হয়েছে যা ২০১৪ সালের তুলনায় ২৬ শতাংশ বেশি। ২০১২ সালে সুন্দরবনেরর এক চোরাশিকারী স্বীকার করেন যে, এক বছরে তিনিএকাই ২৭টি বাঘ মেরেছেন। যদিও বন বিভাগ তার বক্তব্য আমলে নেয়নি। তবে বন বিভাগের নিজেদের প্রতিবেদনই বলছে যে, ১৯৯৯-২০১৫ মেয়াদের ১৬ বছরে সুন্দরবনে বাঘ মারা হয়েছে ৫২টি। অর্থাৎ ৫২টি হত্যার ঘটনা বন বিভাগের নথিপত্রে আছে। নথিপত্রের বাইরে কিছুই নেই, এ কথা মানার যথেষ্ঠ কারণ দেখা যাচ্ছে না।
পাভেল পার্থ আমাদের বন্ধু। জনপ্রতিবেশবিদ্যা নিয়ে কাজ করার জন্য পরিচিত তিনি। একদিনের আড্ডায় বাঘের সংখ্যা নিয়ে কথা উঠলে তিনি বললেন, “১৯৬০’র দশক থেকেই বাংলাদেশ সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা দেখা যাচ্ছে ৩৫০-৪৫০টি। পৃথিবীতে জন্মমৃত্যুর মধ্য দিয়ে পৃথিবীর সব প্রাণীর সংখ্যাবৃদ্ধি হয়। বাঘের কি এগুলো কিছুই হয় না?” আমরা অনেকক্ষণ বিষয়টি নিয়ে মজা করলেও ঘটনাটি কিন্তু মোটেই মজার না।
আর হারিয়ে যাবার দলে প্রতিদিন যোগ হচ্ছে নতুন নতুন বন্যপ্রাণ। ইতোমধ্যেই যা যা হারিয়ে গেছে তা কাঁদলেও ফিরে পাওয়া যাবে না। পারা হরিণ বা কুকুরে হরিণ, বারো শিঙ্গা, বুনোষাঁড়, জাভাগণ্ডার, চিতাবাঘের পাশাপাশি হারিয়ে গেছে বুনোমহিষও যা ষাটের দশকেও দলে দলে চরে বেড়াতো বলে সুন্দরবনের ইতিহাসবিদ এএফএম আব্দুল জলিল লিখে গেছেন। পাখির মধ্যে সাদা মানিক জোড়, কানঠুনি, বোঁচাহাঁস, গগনবেড়, জলার তিতিরসহ অন্তত ১৫টি প্রজাতি আর কোনোদিন সুন্দরবনে দেখা যাবে কি না সন্দেহ। রয়না, কালো হাঙ্গর, তীরন্দাজ, জাভা, কাইক্কা, কাজলী, শিলং, কাইন মাগুর, দাতিনা ও লাক্ষাসহ ১৫-২০ প্রজাতির মাছ হয় এখন আর পাওয়া যায় না, নতুবা খুব দ্রুতই হারিয়ে যাবে এ অঞ্চল থেকে।
বন্যপ্রাণ উজাড় হয়ে যাবার পেছনে যে শুধু অতিরিক্ত সংগ্রহ ও চোরাই শিকার দায়ী, তা নয়। উজানে আড়বাঁধ দেয়ার ফলে সুন্দরবনে স্বাদুপানির অভাব, নদী-খাল মরে যাওয়ায় প্রতিবেশের অধঃপাত, জলোচ্ছ্বাসে বনের ভেতরে নোনাপানি প্রবেশ, বৃক্ষনিধনের ফলে আবাসস্থল ধ্বংস হওয়া, অতিরিক্ত পর্যটকের আনাগোনা, শব্দদূষণ, বিসদৃশ রঙিন ও চকচকে অবকাঠামো এবং উজানের বর্জ্যও কম দায়ী নয়।
সবশেষ দায়টি দিয়েছে স্বয়ং বিশ্ব বন্যপ্রাণ তহবিল (ডাব্লিউডাব্লিউএফ)। এ বছর এপ্রিলে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিশ্বসংস্থাটি বলছে যে, সুন্দরবনের বন্যপ্রাণীর বিপন্নতার কারণ মূলত পাঁচটি : বনসংলগ্ন এলাকায় ভারী শিল্প নির্মাণ, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জাহাজসহ নৌযান চলাচল, অতিরিক্ত মৎস্য সংগ্রহ, বৃক্ষনিধন এবং অদূরদর্শী পানি ব্যবস্থাপনা।
পৃথিবীর সবথেকে বড়ো একক বাদাবন, সুন্দরবন ও তাঁর বন্যপ্রাণ বাঁচাতে এখনই ক্ষতিকর উদ্যোগগুলো বন্ধ করা ও ব্যাপকভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই।
হাসান মেহেদী : সদস্য সচিব, সুন্দরবন পর্যবেক্ষণ দল ([email protected])